নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন ১৬ জুন । ২০০১ সালের এই দিনে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় ২০ জন প্রাণ হারান। পঙ্গুত্ব বরণ করেন জেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি চন্দনশীল সহ আরও অনেকে, যারা আজও দুঃসহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে ২২ বছরেও মামলার বিচার কাজ শেষ হয়নি। সাক্ষীদের অনীহাসহ নানা কারণে বিচারকাজ বিলম্বিত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এই মামলা সংশ্লিষ্টরা।
মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালের ১৬ জুন চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই সময় তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানও অফিসে উপস্থিত ছিলেন। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে ১১ জন ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ৯ জন মারা যান। সব মিলিয়ে মোট ২০ জন প্রাণ হারান। এদের মধ্যে ১৯ জনের পরিচয় জানা যায়। এক নারীর পরিচয় মেলেনি।
নিহতরা হলেন- তৎকালীন শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পি, সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস আকতার হোসেন ও তার ভাই সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ বি এম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামী লীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী, স্বপন রায় ও অজ্ঞাত এক নারী।
হামলায় গুরুতর আহত হন শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক লোক। চিরতরে পঙ্গুত্ববরণ করেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রতন দাস।
বোমা হামলার পর দিন খোকন সাহা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় (একটি বিস্ফোরক অন্যটি হত্যা) জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তৈমুর আলম খন্দকারকে প্রধান করে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের মোট ২৭ জনকে আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করেন।
ঘটনার দীর্ঘ ২২ মাস পর ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে মামলা দুটির ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়, ‘উল্লিখিত ২৭ জনের কেউই চাষাঢ়া আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলায় জড়িত নন। যদি ভবিষ্যতে এই মামলার তথ্য সংবলিত ক্লু পাওয়া যায়, তবে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে।’
দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর সিআইডির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে নিষ্পত্তির জন্য রাষ্ট্রপক্ষকে আদেশ দেন।
তবে একই ঘটনায় আরেকটি মামলা হয়েছিল। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এই ঘটনায় নিহত চা দোকানি হালিমা বেগমের ছেলে আবুল কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান (বর্তমান এমপি), তার ভাই নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমানসহ (বর্তমান এমপি) আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৫৮ নেতাকর্মীকে আসামি করে একটি মামলা করেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালত এ মামলাটি খারিজ করেন।
আগের করা দুটি মামলায় ১৪ বছরে ৭ বার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন এবং ৮ম বার ১৩ বছর পর দুটি মামলায় ২০১৩ সালের ২ মে ৬ জনকে অভিযুক্ত ও ৩১ জনকে অব্যাহতি দিয়ে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুটি মামলার প্রত্যেকটির ৯৪৭ পাতার চার্জশিট দাখিল করা হয়।
এতে মামলা থেকে তৈমূর আলম খন্দকারসহ ৩১ জনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। মামলায় ছয় জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন- নারায়ণগঞ্জে ক্রসফায়ারে নিহত যুবদলকর্মী মমিনউল্লাহ ডেভিডের ভাই শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, ওবায়দুল্লাহ রহমান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু, ভারতের দিল্লি কারাগারে আটক সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন।
আসামিদের মধ্যে ২০১৭ সালে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের অপর একটি মামলায় ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। দুই সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন ভারতের দিল্লি কারাগারে বন্দি, ওবায়দুল্লা রহমান ও কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জামিনে রয়েছেন। কাশিমপুর কারাগারে রয়েছেন শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল।
বোমা হামলার ঘটনা প্রসঙ্গে প্রায় সময় নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান গণমাধ্যমে বলেন, ‘ভুক্তভোগী হিসেবে আমার দাবি, ভারত থেকে মোত্তাকিন ও মোরসালিনকে নিয়ে এসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক। কোন কোন বড় শক্তি, কিংবা কোন বড় দল বা নেতা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তা বেরিয়ে আসবে। এটা হওয়া উচিত।’
বোমা হামলার ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণ করেছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দনশীল। তিনি বলেন, ‘বোমা হামলায় আমি দুটি পা হারালাম। চোখের সামনে ২০ জন নেতাকর্মীকে হারিয়েছি। সব নেতৃবৃন্দকে এক সাথে হত্যা করা ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। এই ঘটনায় মুফতি হান্নান সহ কিছু আসামি ধরা পড়েছে। এছাড়া দুই সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন ২০০৬ সালে গ্রেফতার হয়েছিল। তারা এই ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছিল। তাদের দুজনকে দেখে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাবো। আমাদের কাছে মনে হয়, তারা এই ঘটনার ঘটানোর পেছনে কারো নির্দেশ পালন করেছেন। কিন্তু এই ঘটনার পেছনে মাস্টারমাইন্ড কারা? তাদের খুঁজে বের করা দরকার। এই মামলার ২২ বছর পেরিয়ে গেছে। দ্রুত যেন এই মামলার বিচার পাই সেই দাবি জানাচ্ছি।
বোমা হামলায় নিহত শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পির ছোট ভাই ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. কামরুল হাছান মুন্না বলেন, ‘গত ২২ বছরেও বিচার কাজ শেষ না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছি। আর কবে বিচার পাবো। দ্রুত বিচার সম্পন্ন করার দাবি জানাচ্ছি।
জেলা জজ কোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মো. মনিরুজ্জামান বুলবুল বলেন, ‘ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলার ঘটনা খুবই ন্যাক্কারজনক। এই মামলার ২০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। আশা করছি খুব দ্রুত সম্পন্ন হবে। এই মামলায় মোট ৬ জন আসামি। তাদের মধ্যে আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মোত্তাকিন একটি মামলায় ভারতের জেলে আটক রয়েছে। সেখানকার মামলা নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এখানে আনা যাচ্ছেনা। এটা সরকারী চুক্তির বিষয়। সরকারি ভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদেরকে আনতে হবে।
মামলার সাক্ষীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই মামলায় যেসব সাক্ষীদের নাম দেওয়া আছে, তাদের অনেককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। যদি তাদের একান্তই না পাওয়া যায়। যেহেতু মামলায় ২০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সুতরাং বাকি সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে মামলা নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে। এই মামলা যেন দ্রুত নিস্পত্তি হয় সেই চেষ্টা করেছি।