শীতের আবেশ ছড়িয়ে পড়েছে রূপগঞ্জের গন্ধবপুর নওগাও গ্রামসহ পুরো ৫টি এলাকায়। প্রস্তুতি শুরু হয়েছে শীতের। শীত মানেই বড়ি দিয়ে আলু ফুলকপির ঝোল, সিম-বেগুন, পাঁচ মিশালি চচ্চড়ি, কচুর শাক বা কৈ-শোল মাছের ঝোল। আর গরম ভাতে ঘি আর কালোজিরে বা পোস্ত দেওয়া ছোট্ট ছোট্ট মাসকলাইয়ের ডালের বড়ি ভাজা হলে তো এক থালা ভাত নিমেষে শেষ!
শীতের খাবারে ভিন্ন স্বাদ আনতে মাছ-সবজিতে বড়ির প্রচলন দীর্ঘদিনের। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী শীতের পিঠাপুলি খাবারের মতো বড়ির বেশ কদর রয়েছে। মুখরোচক সুস্বাদু এই খাদ্য অতি যত্নসহকারে শৈল্পিকভাবে তৈরি করে আসছে রূপগঞ্জের ৫টি গ্রামের প্রায় ৭০টি পরিবার।
শীতের শুরু থেকে চার মাস এই বড়ি তৈরির কাজে বেশ ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।কারিগররা বলেন, বাজারে ডালের দাম বৃদ্ধির কারণে এখন বিক্রি কম। তবু বসে নেই এই মাসকলাই-কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগরেরা। এই বড়ি স্থানীয়দের চাহিদা মিটিয়ে সরবরাহ হচ্ছে দেশে-বিদেশে।
কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আত্মীয়-স্বজনের হাত ঘুরে সুস্বাদু বড়ি এখন প্রবাসী বাঙালিদের রসনা তৃপ্ত করছে। এ উপজেলার মানুষ যারা দুবাই, সৌদি আরব, কাতার-ওমান, আরব-আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইতালি, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে কর্মরত রয়েছেন তাদের জন্য পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি। রূপগঞ্জের ৭০টি পরিবার মাসে প্রায় ৪২ হাজার কেজি ডালের বড়ি তৈরি করে আসছে। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় কোটি টাকা।কারিগরেরা বলেন, শীতের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাজারে নানা ধরনের সবজির সমাহার দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলের খালবিল নদীতে প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। এসময় মাছের সাথে প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন ধরনের সবজি বাজারে ওঠে। আর এই মাছ ও সবজি রান্নাতে ব্যবহার হয় সুস্বাদু ডালের বড়ি। সেই চাহিদা পূরণ করছে গন্ধবপুর নওগাও, গন্ধবপুর বারোবিঘা, নিমেরটেক, টান মুশরী গ্রামের মাসকলাই ও কুমড়া বড়ি তৈরির কারিগররা। পরিবারের কাজের ফাঁকে কুমড়া বড়ি তৈরি করে বাড়তি উপার্জনের একটি অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন গ্রামের নারী ও পুরুষরা।বাজারে চাহিদা আর স্বাদের ভিন্নতার জন্য চার প্রকারের ডাল মসলা আর চালকুমড়া দিয়ে তৈরি হয় এই কুমড়া বড়ি। বাজারে প্রচলিত এ্যাংকার, মটর, ছোলা ও মাশকালাইয়ের ডাল ব্যবহার করা হয় এই বড়ি তৈরিতে।
স্থানীয়রা জানান, ৫টি গ্রামের প্রায় ৭০টি পরিবার এ কুমড়া বড়ি তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।ৰগন্ধবপুর নওগাও গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সারি সারি কুমড়া বড়ি তৈরি করে শুকানোর জন্য রোদে দিয়েছেন। আর এ কাজে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরাও কাজ করছেন। ডালভেদে দাম নির্ধারণ হয় কুমড়া বড়ির। ১৮০ টাকা কেজি থেকে শুরু করে ২৫০ টাকা কেজি পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। ভোর থেকে উপকরণ তৈরির প্রস্তুতি শুরু করে সূর্য ওঠা পর্যন্ত চলে এই কাজ। শীতের প্রখর রোদে দু-তিন দিন শুকিয়ে বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত করা হয় কুমড়া বড়ি।
নগরপাড়া এলাকার গৃহবধূ নাজমা আক্তার বলেন, শীত আসলে ঘরে ডালের বড়ি থাকা চাই। ডালের বড়ির সাথে ফুলকপি আর কৈ মাছ দিয়ে সুস্বাদু তরকারি তৈরি করি।
কুমড়াবড়ি তৈরির কারিগর সরসরি শীলা দাস বলেন, নওগাও ও বারোবিঘা এলাকার প্রায় ৩০টি পরিবার কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ করে আসছেন। এছাড়া নিমেরটেক, টান মুশরী, কাঞ্চন এলাকার আরো ৪০টি পরিবার এলাকার চাহিদা মিটিয়ে বাইরে জেলাগুলোতে সরবরাহ করা হচ্ছে। শীতে কুমড়া বড়ির চাহিদা বেড়ে যায়।
নিমেরটেক এলাকার বড়ি তৈরির কারিগর মণিকা রাণী দাস বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর ধইরা এই পেশায় আছি। একটা সময় অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। আগে সারাদিন ডাল ভিজিয়ে রেখে শিল-পাটা দিয়ে বেটে বড়ি তৈরি করতে হতো। এতে সময় লাগত অনেক বেশি। এখন শিল-পাটার বদলে ডাল মেশিনে ভাঙানো হয়। পরে বড় গামলা বা বালতিতে ডালের গুঁড়া, পাকা চালকুমড়া, কালোজিরা, গোলমরিচ এবং মসলা মিশিয়ে সুস্বাদু কুমড়ার বড়ি তৈরি করা হয়।
‘দিপা রাণী দাস বলেন, ‘এ বছর ডালসহ উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় লাভের পরিমাণ কমে গেছে। তবু বসে না থেকে প্রতিবছরের মতো এবারো কুমড়া বড়ি তৈরির কাজ করছি। গ্রামের প্রায় ২০টি পরিবারের নারীরা এই কাজ করে থাকেন। আমরা শুধু মালের যোগান দিই।
‘বড়ি তৈরির কারিগর শিউলী রাণী দাস বলেন, ‘২০ বছরের অভিজ্ঞতা আমার কাজের। শীতের এই চার মাস আমাদের ঘরে বসে কাজ করে একটু বাড়তি আয় হয়। মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আমরা পাই।
মধুমালা রাণী দাস বলেন, ‘এহানকার ডালের বড়ির চাহিদা বেশি। দিনে ৩ কেজি ডালের বড়ি তৈরি করা যায়। কারিগর ছাড়াও পরিবারের লোকজন সহযোগিতা করে।’ তার মেয়ে প্রীতি রাণী দাস নবম শ্রেণিতে পড়ে। অবসর সময়ে সে তার মায়ের কাজে সাহাজ্য করে বলে জানা মধুমালা রাণী।
স্থানীয় কারিগরেরা বলেন, শিল-পাটায় বাটা ডালের তৈরি বড়ির চাহিদা ও দাম সব সময় একটু বেশি থাকে। আবার অনেকেই অর্ডার দিয়ে কুমড়া বড়ি তৈরি করে নিচ্ছেন। পরে বিভিন্ন দেশে কর্মরত স্বজনদের কাছে পাঠানো হচ্ছে এই বড়ি।
৭০ বছর বয়সী সুনীল চন্দ্র দাস বলেন, ‘মাসে রূপগঞ্জের ৫টি এলাকা থেকে প্রায় ৪২ শ/৪৩ শ কেজি ডালের বড়ি পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। ডালের দাম না বাড়লে এ ব্যবসা খারাপ ছিল না। সবাই পরিবার নিয়া ডাল-ভাত খাইতে পারত। কয়েক বছর ধইরা লাভ কম অয়। হেরপরেও ভালা আছি।
‘ডেমরা এলাকা থেকে ডালের বড়ি নিতে এসেছেন ইমাদ আকাশ। পার্বতী শীলা দাসের বাড়িতে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘গত ৪০ বছর ধইরা এহান থেইক্কা ডালের বড়ি কিনা নিয়া বেঁচি। লাভ হয়। হপ্তায় দুইদিন নেই। মাসকলাইয়ের অরজিনাল বড়ি পাইকারি নিই ২৫০ টাকা কেজি। আর কুমড়ার বড়ি পাইকারি নিই ২০০ টাকা কেজি।
‘পাইকার বজন চন্দ্র দাস ও প্রদীপ বিশ্বাস বলেন, ‘রূপগঞ্জের তৈরি ডালের বড়ি সারাদেশের পাশাপাশি দেশের বাইরে যায়। গুণগত মান ভালো থাকায় ও ভেজাল না করার কারণে এখানকার ডালের বড়ির চাহিদা বেশি।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফয়সাল হক বলেন, ‘রূপগঞ্জে ডালের বড়ি তৈরি হয় সেটা জানা ছিল না। তবে খুব ভালো একটা বিষয় দেশের পাশাপাশি বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে সহযোগিতার জন্য চেষ্টা করব।