স্টাফ রিপোর্টারঃ
নারায়ণগঞ্জে নারী শিল্পী ও মঞ্চের অভাবে থিয়েটার শিল্প ধুকে ধুকে চলছে। এক সময় জেলায় একমাত্র নাট্য চর্চার স্থান ছিল শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন। তবে পাঠাগার ভবনের সংস্কার কাজ সহ নানা জটিলতায় দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে থিয়েটার কর্মীরা সেখানে নাট্য চর্চা করতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ থিয়েটার কর্মীরা নাট্য চর্চায় বিমুখ হয়ে পড়েছে। এদের কেউ কেউ জীবিকা নির্বাহের তাগিদে থিয়েটার চর্চা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। আবার অনেকের কাছে নাট্য চর্চা নেশায় পরিণত হয়েছে, তাদের অধিকাংশ অন্য পেশার পাশাপাশি থিয়েটারকে ভালবেসে আকড়ে ধরে রয়েছেন। নাট্য শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে অর্থ সংকট সহ নানা প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে থিয়েটার শিল্প ধীরে ধীরে নিস্প্রাণ হয়ে পড়ছে।
নারায়ণগঞ্জ শহরে দীর্ঘদিনের পুরনো আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনে এক সময় নাট্য চর্চা করতো থিয়েটার কর্মীরা। তবে ২০১০ সালে পুরনো পাঠাগার ভবনটি ভেঙে ৬ তলা নতুন ভবনের কাজ শুরু করা হয়। ২০১৭ সালে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবনের কাজ সম্পন্ন হয়। তবে ওই ভবনে নাট্য চর্চা করার রিহার্সাল রুম নেই। এছাড়া নাটক পরিবেশন করার হল রুম থাকলেও তা খুবই ব্যায়বহুল। ফলে সেখানে নাট্য চর্চার কোন সুযোগ নেই।
এরুপ সংকটের মধ্যে কয়েক বছর আগে থিয়েটার ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা জেলায় হল রুমের দাবি জানিয়ে আসছিল। পরে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। গত বছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন উদ্বোধন করা হয়। তবে সেখানে হল রুম ভাড়া হিসেবে প্রতি ঘণ্টার জন্য তিন হাজার টাকা গুণতে হয়। সে হিসেবে একটি নাটকের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করতে হয়। এতো টাকার জোগান দেওয়া অসম্ভব বলে নাট্য চর্চায় বাধা রয়েই গেছে। ফলে শিল্পকলা একাডেমি ভবনে শুধু নাটক পরিবেশন করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ৬টি থিয়েটার সংগঠন রয়েছে নারায়ণগঞ্জ জেলায়। সংগঠনগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ থিয়েটার, সশেপ্তক নাট্যদল, জনে জন নাট্য সম্প্রদায়, সিরাজউদ্দৌলা নাট্যদল, উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদ, ঐকিক থিয়েটার। এছাড়া আরও রয়েছে- উঠান থিয়েটার, নাটুয়া, নারায়ণগঞ্জ নাট্যাঙ্গন, এই বাংলায়, শ্রুতি, মাসদাইর থিয়েটার সহ প্রায় ১২টির মত থিয়েটার নাট্যদলের সংগঠন রয়েছে। নাটক চর্চার স্থান সংকটের মধ্যে ঐকিক থিয়েটার রাজধানীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নাটক করেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি নাট্য দল বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাটক চর্চা করেছে।
উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল হাসান জেমস বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জে থিয়েটার শিল্পীরা ভাল নেই। এ জেলায় থিয়েটার চর্চার করার জায়গা নেই। জেলা শিল্পকলা ও চুনকা পাঠাগারে নাটক মঞ্চস্থ করার ব্যবস্থা রয়েছে, কিন্তু চর্চা করার ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া শিল্পকলা ও চুনকা পাঠাগারে হলরুম অনেক টাকা ভাড়া দিতে হয়। এক দিনের একটা শো এর জন্য ত্রিশ হাজার টাকা হল রুম ভাড়া গুণতে হয়। এতো টাকার জোগান দেওয়া অসম্ভব। তাছাড়া থিয়েটার কথা জানতে পারলে কোন বাড়ির মালিক ঘর ভাড়া দেয় না। তবে এতো সংকটের মধ্যেও অনেকগুলো নাটক আমরা করেছি। উল্লেখযোগ্য নাটক সমূহ হল- হুমায়ুন আহমেদ ১৯৭১, মনির চৌধুরীর ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত ‘কবর’ নাটক, এই দেশে এই বেশে, মাছের বেজবান, ব্ল্যাক আউট।
থিয়েটার শিল্পী হলেও জীবিকা নির্বাহের জন্য দীর্ঘ ৮ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যাংকে চাকরী করে আসছেন রাকিবুল হাসান জেমস। বর্তমানে তিনি চাকরী ছেড়ে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘চাকরী করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। তবে থিয়েটার করা নেশায় পরিণত হয়েছে। একারণে চাকরীর পাশাপাশি থিয়েটার করে আসছি। কিছুদিন আগে আমার পরিচালনায় ব্ল্যাক আউট নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। তবে বর্তমানে অনেক কর্মী সংকট রয়েছে। এই সংগঠনে সক্রিয় ২০ জন কর্মী রয়েছে। এর মধ্যে ৮ জন নারী কর্মী রয়েছে। আমাদের সমাজে ছেলে-মেয়েরা টিকটক করছে। অথচ থিয়েটারের জন্য শিল্পী পাচ্ছিনা। তবে আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা রয়েছে- থিয়েটার করা মেয়ে মানে উচ্ছ্বন্নে যাওয়া। এটা একেবারে ভুল ধারণা। নবম শ্রেণি থেকে অনার্স প্রথম বর্ষ পর্যন্ত নারী শিল্পী পাওয়া যায়। এর পরে সেই নারী শিল্পীদের বিয়ে হয়ে যায়। তাছাড়া থিয়েটার করে কোন শিল্পীর জীবিকা নির্বাহ করার মত পরিস্থিতি নারায়ণগঞ্জে তৈরি হয়নি। ফলে দিন দিন থিয়েটার শিল্পী কমে যাচ্ছে।
অভিনেতা ও উঠান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা শোহেব মনির বলেন, সকল কলার সমন্বয় হচ্ছে নাট্যকলা। অথচ এই নাট্য শিল্প ধুকে ধুকে প্রাণ হারাচ্ছে। নাট্য চর্চা এখন নিভু নিভু অবস্থা। আলী আহাম্মদ পৌর চুনকা পাঠাগার সংস্কার কাজের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘ দিন এ জেলায় নাট্য চর্চা বন্ধ ছিল। ফলে নাট্য দলগুলো গুছিয়ে উঠতে পারছেনা। এছাড়া নাটক করতে টাকার প্রয়োজন। অর্থ জোগান দেওয়ার স্পন্সর নেই। এতো সংকটের মধ্যেও আমরা নাটক করেছি। আমার উল্লেখযোগ্য নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে-বক্তাবলী, লখাই প্রমুখ।
থিয়েটার ও সাংস্কৃতি চর্চার পাশাপাশি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করান শোহেব মনির। তিনি বলেন, ভর্তুকি দিয়ে উঠান চারু-নাট শিক্ষাঙ্গন নামে একটি সাংস্কৃতিক স্কুল পরিচালনা করে আসছি। এছাড়া উঠান থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার এখানে প্রায় ৩০ জন শিল্পী রয়েছে, যার মধ্যে ৮ জন নারী শিল্পী রয়েছে। নারী কর্মী সংকটের ফলে নাটক তুলতে পারছিনা। আর যে কয় জন নারী শিল্পী রয়েছে তারা যথাযথ সময় দিতে পারছেনা। কারণ থিয়েটার দিয়ে তাদের কোন উপার্জন নেই। ফলে এই সংকট ক্রমশ বিরাট আকার ধারণ করছে।
৫০ বছর ধরে থিয়েটার নিয়ে কাজ করছেন জনে জন নাট্য সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা বাহাউদ্দিন ভুলু। তিনি বলেন, ‘ ২০১০ সালে শহরের আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগার ও মিলনায়তন ভবন সংস্কারের পরে থিয়েটার নাটকের বেহাল দশা শুরু হয়। ওই সময়ের আগে চুনকা পাঠাগারে ঘণ্টায় ২০ টাকা ভাড়া হিসেবে নাটক চর্চা করার সুযোগ ছিল। চুনকা পাঠাগারের সংস্কার কাজ সম্পন্ন হলেও সেখানে থিয়েটার নাটক করার রিহার্সাল রুম নেই। ফলে দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে থিয়েটার শিল্পীরা নাট্য চর্চা করতে পারছেনা। শিল্পীরা থিয়েটার থেকে দূরে সরে গেছে। সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। গতবছর জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন চালু হয়েছে। কিন্তু সেখানে প্রতি ঘণ্টা হিসেবে ৩ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এতো টাকা খরচ করে থিয়েটার করা সম্ভব নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলার মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী সহ সংশ্লিষ্টদের জানিয়েছি। এছাড়া সরকারিভাবে আমাদের বছরে কিছু টাকা দেওয়া হয়। তবে সেটা যথেষ্ট নয়।
নারী কর্মী সংকটের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের ৩৩ জন শিল্পী কর্মী রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ৩ জন নারী। নারী কর্মীর সংকট রয়েছে। নারী কর্মীদের যাতায়াত ভাড়া সহ তাদের পেছনে আরও অনেক খরচ রয়েছে। অর্থ সংকটের ফলে এসব খরচ সেভাবে বহন করা সম্ভব হয়না। যেকারণে সংকট দেখা দিয়েছে। আর আমাদের সংগঠনের উল্লেখ্যযোগ্য নাটক হল- এবং লাঠিয়াল, মানিক বাউলের পালা, ফুলজান সমাচার ইত্যাদি। এসব নাটক সমূহ জেলার বাইরেও মঞ্চস্থ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক উত্তম কুমার সাহা বলেন, থিয়েটারের কর্মী সংখ্যা দিন দিন কমছে। ইতোমধ্যে কয়েকজন সদস্য মারা গেছেন। আর নারী কর্মীদের মধ্যে অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। ২৫ জন কর্মী নিয়ে আমাদের সংগঠন চলছে। এর মধ্যে মাত্র একজন নারী কর্মী রয়েছে। একজন নারী কর্মী দিয়ে সংগঠনের কাজ পরিচালনা করা সম্ভব হচ্ছেনা। জিয়া হল বন্ধ থাকায় আমরা দীর্ঘদিন পথে পথে ঘুরেছি। পরে আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি ভবন করা হয়েছে। এখন অন্তত আমাদের একটা গতি হয়েছে।