গত ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে বিএনপির ডাকা সমাবেশে নেতাকর্মীদের ওপরে পুলিশ হামলা করেছে দাবি করে সারাদেশে হরতাল ও পরে দুই দফায় অবরোধের ডাক দেয় দলটি। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে দলের নেতাকর্মীরা নারায়ণগঞ্জ জেলার সড়ক ও মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযোগ, গাড়ি ভাঙচুর সহ পুলিশের সাথে ব্যাপক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছেন। এতে দুটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগ সহ অন্তত ১০টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এসব ঘটনায় জেলার সবকটি থানায় দফায় দফায় ১৫ টি মামলায় ২৯৪ জন নেতাকর্মীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
বিএনপির ডাকা হরতাল ও অবরোধের সময়ে নাশকতার অভিযোগে জেলায় মোট ১৫টি মামলা হয়েছে। মামলা সূত্রে জানাগেছে, নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় ১টি, ফতুল্লা মডেল থানায় ৩টি, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ২টি, বন্দর থানায় ২টি, আড়াইহাজার থানায় ২টি, সোনারগাঁও থানায় ২টি ও রূপগঞ্জ থানায় ৩টিসহ মোট ১৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এসকল মামলায় ৭১৪ জন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এসব মামলায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য ও নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামান মনির, মোস্তাফিজুর রহমান ভূইয়া দিপু, অধ্যাপক মামুন মাহমুদ, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির আহবায়ক সাখাওয়াত হোসেন খান, সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু, জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক মাশুকুল ইসলাম রাজিব সহ অসংখ্য নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) চাইলাউ মারমা বলেন, হরতাল ও অবরোধকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় মোট ১৫ টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন পর গত ২৯ অক্টোবর সারা দেশে হরতালের ডাক দেয় বিএনপি দলটি। তাদের সাথে তাল মিলিয়ে জামায়াতে ইসলাম দলটি হরতালের ডাক দিয়েছে। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীরা সড়কে নেমেছে। হরতালের দিন রবিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া বালুর মাঠ এলাকায় মিছিল নিয়ে জড় হয় মহানগর ও যুবদল বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বিএনপির নেতাকর্মীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া সহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বিএনপির নেতাকর্মীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুড়ে মারে। পরিস্থিতি শান্ত করতে পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। এতে একজন পুলিশ সহ অন্তত ৯ জন আহত হয়েছেন। ওই দিন সকালে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় বিএনপির একটি মিছিল থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলাচল করা উৎসব ট্রান্সপোর্টের একটি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়৷ পরে বাসটিতে আগুন দেওয়া হয়৷ একই এলাকায় বন্ধু পরিবহনের আরেকটি বাসে ভাঙচুর চালানো হয়৷ তবে দু’টি ঘটনায় কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি ৷ এছাড়া আড়াইহাজার উপজেলায় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে অন্তত ১৫ জন আহত হয়েছেন।
এক দিন বিরতি দিয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে টানা তিন দিন অবরোধের ডাক দেয় বিএনপি দলটি। অবরোধের প্রথম দিন (মঙ্গলবার) সকালে আড়াইহাজার উপজেলায় মহাসড়ক অবরোধ করতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এ সময় বিএনপির সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে কুপিয়ে ও ইটের আঘাতে তিন জন পুলিশ সদস্যকে আহত করা হয়। এছাড়া বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অন্তত ২০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। অবরোধের দ্বিতীয় দিনে বুধবার (১ নভেম্বর) সকালে নারায়ণগঞ্জের তিন মহাসড়কে (ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট ও এশিয়ান হাইওয়ে) অগ্নিসংযোগ সহ তিনটি গাড়ি ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে।
একইভাবে অবরোধের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সকালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ের বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বালিয়ে ও ককটেল বিস্ফোরণ করেছে বিএনপির নেতাকর্মীরা। এছাড়া সড়কে তিনটি গাড়ি ভাঙচুর করেছে অবরোধকারীরা। এ সময় সিদ্ধিরগঞ্জ থানা বিএনপির সাবেক যুগ্ম-আহ্বায়ক টিএইচ তোফাসহ তিন জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া আড়াইহাজারে পুলিশে ওপরে হামলার ঘটনায় বৃহস্পতিবার (২ নভেম্বর) সকালে রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেল থেকে বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুকুল ইসলাম রাজীব সহ ১০ জন নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করে র্যাব-১১।
মধ্যেখানে দুই দিন বিরতি দিয়ে বিএনপি দলটি ফের দ্বিতীয় দফায় অবরোধের ডাক দেয়। অবরোধ শুরুর আগের দিন শনিবার (৪ নভেম্বর) রাতে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় অনাবিল বাসে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এতে বাসের সবগুলো সিট সহ বিভিন্ন অংশ আগুনে পুড়ে যায়। রবিবার (৫ নভেম্বর) অবরোধের প্রথম দিনে জেলার বিভিন্ন স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে ও অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেছে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এমনকি ঝটিকা মিছিল বের করেছে নেতাকর্মীরা। এছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ককটেল বিস্ফোরণ সহ অন্তত ৩টি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। আর এশিয়ার হাইওয়ে এবং ঢাকা-সিলেট মহাসড়কেও টায়ার জ্বালিয়ে ও অগ্নিসংযোগ করে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে দলের নেতাকর্মীরা।
দ্বিতীয় দফার অবরোধের শেষ দিনে নারায়ণগঞ্জে পৃথক তিনটি স্থানে বিক্ষোভ করেছেন অবরোধকারীরা। সোমবার (৬ নভেম্বর) সকালে সিদ্ধিরগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনে ও গোদনাইল এলাকায় এবং বন্দর উপজেলার মদনপুরে সড়কে টায়ার, কাঠের চৌকিতে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করেন তাঁরা। এদিকে রূপগঞ্জে অভিযান চালিয়ে অবরোধের সময়ে অগ্নিসংযোগ, গাড়ি ভাঙচুর সহ সহিংস কাজে ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত ককটেল, বোমা ও অগ্নেয়াস্ত্র সহ ছাত্রদলের চার নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২টি ককটেল, ১০টি পেট্রলবোমা, একটি বিদেশি পিস্তল ও ম্যাগজিন উদ্ধার করা হয়। আটককৃতরা হলেন- জেলা ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি সুলতান মাহমুদ, রূপগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সাবেক সদস্য সচিব মাসুদুর রহমান, সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফ বিল্লাহ ও দাউদপুর ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা তৌহিদ হাসান।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার থানায় বিএনপি-জামায়াতের হরতাল ও অবরোধে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পরিকল্পনায় ও ঘটনায় জড়িত থাকার কথা তারা স্বীকার করেছে। তাদের মোবাইলফোনের সংরক্ষিত ম্যাসেজ, কথোপকথন, ছবি ও ভিডিও পর্যালোচনা করে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে।