কোটা ইস্যুতে ধ্বংসযজ্ঞ তাণ্ডবে চারদিকে ধ্বংসস্তূপ

কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নারায়ণগঞ্জে ধ্বংসযজ্ঞ তাণ্ডব চালায় দুষ্কৃতিকারীরা। গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) থেকে রোববার পর্যন্ত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সংঘর্ষে ৮ জন নিহত সহ শত শত লোক আহত হয়েছেন। অনেক গুরুতর আহত হয়ে এখনো হাসপাতালের বেডে কাঁতরাচ্ছেন। এছাড়াপুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নারায়ণগঞ্জ জেলা কার্যালয়,পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, পুলিশবক্স, পুলিশ ফাঁড়ি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড, শীতল পরিবহনের ২৬টি বাস সহ অর্ধশতাধিক স্থাপনা ভাঙচুর করে ও আগুন দিয়ে লুটপাট করেছে দুর্বৃত্তরা। এসব ঘটনায় নাশকতার অভিযোগ তুলে ১৯৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, কোটা ইস্যুতে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াত এই তাণ্ডব চালিয়েছে।

যেভাবে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় : বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) সকাল ১১ টার দিকে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া এলাকায় কোটা সংস্কার ও সারা দেশে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে ও পুড়িয়ে দেয়। পরে পুলিশের একাধিক টিম গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। এভাবে দিনব্যাপী দফায় দফায় চলে সংঘর্ষ। এতে অন্তত শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন।এই ঘটনায় ওই দিন শহরের অন্তত ৩টি মার্কেট সহ পুলিশের দুটি গাড়ি ও পুলিশ বক্স সহ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। রাতে সাইনবোর্ড এলাকায় পিবিআই এর কার্যালয়ে ভাংচুর করে আগুন দেওয়া হয়। এমনকি অস্ত্র লুট করা হয়েছে। একইভাবে জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের কার্যালয় ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। এতে পুরো জেলা আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়।

একইভাবে শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজের পরে শহরের ডিআইটি এলাকায় বিক্ষোভ শুরু করে আন্দোলনকারীরা। তাদের প্রতিহত করতে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মাঠে নামে। তিন দফায় তাদের ধাওয়া দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় তাণ্ডব চালায় আন্দোলনকারীরা। ডিআইটি এলাকার হাতিল ফার্ণিচারের শো-রুম, গাজছুল আজম সিটি মার্কেট সহ বেশ কয়েকটি দোকান ভাঙচুরা করে মালামাল লুট করা হয়। একইভাবে নায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেড, নম পার্ক, যুব উন্নয়ন অফিস 

এসবি ফ্যাশন নামে একটি গার্মেন্ট, শীতল পরিবহনের অন্তত ২৬টি বাস সহ বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়া আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে ৮টি পিকআপভ্যান ও ২টি মোটরসাইকেল সহ বেশ কিছু স্থাপনায় ভাঙচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। 
তবে

 শনিবার থেকে সারাদেশের ন্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় কারফিউ জারি করা হয়। এতে নারায়ণগঞ্জ শহরে স্বস্তি ফিরে আসে। তবে নারায়ণগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় পুলিশ ও যৌথ বাহিনীর সাথে  আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এ সময় শিমরাইল এলাকায় ইব্রাহিম খলিল মার্কেটে আগুন দেয় আন্দোলনকারীরা। সেই ভবনের ৭ম তলায় অবস্থিত হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়িকে লক্ষ্য করে আগুন দেওয়া হয়। পরে খবর পেয়ে র‌্যাবের কর্মকর্তারা হেলিকপ্টার দিয়ে ৩৭ জন পুলিশ কে উদ্ধার করে। এ সময় যৌথ বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত চার জন আন্দোলনকারী নিহত সহ ২০ জন আহত হয়েছেন। একইভাবে রবিবারও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড থেকে শিমরাইল ও চিটাগাংরোড এলাকায় যৌথ বাহিনীর সাথে দফায় দফায় আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত একজন নিহত সহ ১০ জন আহত হয়েছেন। সোমবার থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়। নাশকতাকারীরা পিছু হটে। সেদিন পুড়ে যাওয়া শিমরাইল এলাকার ইব্রাহিম খলিল মার্কেট ভবনে তল্লাশি চালিয়ে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ, হাসপাতাল ও স্থানীয় সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

নারায়ণগঞ্জ শহরের ৩শ শয্যা বিশিষ্ট খানপুর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আবুল বাশার বলেন, এই আন্দোলনের সময়ে সংঘর্ষে মারা যাওয়া দুজনের লাশ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এছাড়া ১৫৯ জন আহত অবস্থায় চিকিৎসা নিয়েছেন।

বিভিন্ন হাসপাতাল ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এই ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়েছেন। আর আহত হয়েছেন কয়েক শতাধিক। 

নাশকতার অভিযোগে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের আটক করা হয়েছে উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত নাশকতার ঘটনায় জেলার  ৮টি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে ৬টি এবং নারায়ণগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও নারায়ণগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের কর্মকর্তারা দুটি মামলা করেছে। এই ঘটনায় দুটি দফায় যথাক্রমে বিএনপি-জামায়াতের ১২০ ও ৭৪ জনকে আটক করা হয়েছে।

যুদ্ধ করে জেলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, প্রথমদিকে কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। তবে একটা পর্যায়ে দেখতে পেয়েছি, এই আন্দোলন ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণে নাই। স্বাধীনতা বিরোধীরা এই আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে নাশকতা ও ধ্বংসযজ্ঞ কর্মকাণ্ড চালায়। এই ধ্বংসযজ্ঞ যারা করেছে প্রথমদিকে তারা ছাত্রদের সাথে মিশে গিয়েছিল। এর এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্ররা যখন ঘোষণা দিল যে, তারা এই  ধ্বংসযজ্ঞ সমর্থন করে না। এরপরও কিন্তু নাশকতাকারী ও দুষ্কৃতিকারীরা এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গেছে। আমরা সরকারি অফিস রক্ষার্থে নাশকতাকারীদের সাথে এক ধরনের যুদ্ধ করেছি। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। 

নারায়ণগঞ্জ জেলা ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক ফখর উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, এই আন্দোলনের আমাদের একটি গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনায় ফতুল্লা থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। আর পুরো জেলার সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা আগুনে পুড়েছে। সেসব বিষয় নিরুপণ করে বলা সম্ভব হবে।