কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে ঘিরে (গত ১৮ জুলাই থেকে ২২ জুলাই পর্যন্ত) গত ৫ দিন ধরে কোটা ইস্যুতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া সহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরে পুরো জেলা লণ্ডভন্ড হয়ে যায়। এ সময় নারায়ণগঞ্জ জেলায় সরকারি- বেসরকারি অর্ধশতাধিক প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে দুষ্কৃতিকারীরা। লুটপাট করে দামি দামি মালামাল নিয়ে গেছে দুষ্কৃতিকারীরা। এমনকি পুলিশ-প্রশাসনের বিভিন্ন স্থাপনাও তাদের হামলা ও অগ্নিসংযোগ থেকে রেহাই পায়নি। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৩২ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে । এই সহিংসতার ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে অন্তত ৮ জন নিহত সহ চার শতাধিক আহত হয়েছেন। এর বিপরীতে এখন পর্যন্ত ৩১ টি মামলা হয়েছে; তাতে ৫৮৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। পুলিশ বলছে, কোটা ইস্যুতে আন্দোলনের নামে শিক্ষার্থীদের কাধে ভর করে বিএনপি-জামায়াত এই তাণ্ডব চালিয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২শত ৩২ কোটি ১৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা ছাড়িয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. সাকিব আল রাব্বি।
মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ : ২শত ৩২ কোটি ৫৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা।
সরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ : জেলা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের বিভিন্ন আসবাবপত্র ও বিভিন্ন স্থাপনা অগ্নিসংযোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিকেশন নারায়ণগঞ্জ অফিসের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৫ লাখ টাকা, ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নির্বাপনের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরে প্রায় ৩ কোটি ২০ হাজার টাকা, জেলা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর, ৫টি পুলিশ বক্স ভাঙচুর ও অগ্নিসংগের ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নীচ তলার চারটি গাড়ি, ১০ মোটরসাইকেল, কম্পিউটার সহ আসবাবপত্র ও ওয়ান ব্যাংক লুটপাট করে ৫০ কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি, তথ্য অফিসের গাড়িতে অগ্নিসংযোগে ৩০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি, জেলা যুব উন্নয়ন অফিসের কার্যালয় আগুন দিয়ে ভাঙচুর করে ১০টি মোটরসাইকেল, একটি মাইক্রোবাস সহ ৪টি গাড়ি এবং বিভন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে ৯৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে সরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৮৩ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকা।
বেসরকারিভাবে ক্ষয়ক্ষতি : ফতুল্লার ভূইগড়ে অবস্থিত এসবি স্টাইল কম্পোজিট লি. নামের একটি গার্মেন্টে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করে ১০০ টন কাপড়, ২৬টি গাড়ির, ১০টি ল্যাপটপ, ৫০ টি ডেক্সটপ কম্পিউটার, নগদ অর্থ ১০ লাখ টাকা লুট সহ দু্টি বহুতল ভবন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এতে প্রায় ১শত ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শীতল পরিবহনের ২৪টি গাড়ি অগ্নিংসযোগে ১২ কোটি টাকা,
জালকুড়িতে নম পার্কের অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ঘটনায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা, সানারপাড়স্থ মদিনা গ্রুপের স্থাপনায় ভাঙচুর সহ দুটি প্রাইভেট গাড়িতে অগ্নিসংযোগে ১৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডের দোকান ভাঙচুর, একাউন্ট থেকে ১১ লক্ষ টাকা লুট, দুটি মোটরসাইকেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়, ১৪ কম্পিউটার সহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুর করে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৯০ লাখ টাকা, শিমরাইল এলাকায় হাজী ইব্রাহিম খলিল কমপ্লেক্স এন্ড প্রিয়ম নিবাসে ১৪টি দোকান ও রেস্টুরেন্ট ভাঙচুরে ৮০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি, একই এলাকার এন. এস সুপার মার্কেটের দুটি দোকান ও রেস্টুরেন্ট ভাঙচুরে ১৫ লক্ষ টাকা, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ অফিসের পিকআপ ভ্যান ভাঙচুরের দেড় লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এতে বেসরকারিভাবে এক শত ৪৮ কোটি ৫০ লাখ ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া শহরের ২ নং রেলগেইট এলাকায় জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভবন, এসি ও কম্পিউটার সহ বিভিন্ন আসবাবপত্র ভাঙচুরের ঘটনায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই দাবি করেছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই বলেন, বিএনপি-জামায়াত-শিবির তাণ্ডব চালিয়ে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ অফিসের বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে। এতে প্রায় ৪০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
তবে জেলার অরও অনেক মার্কেট ও দোকানে ভাঙচুর- অগ্নিসংযোগ সহ লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সড়কে ও মহাসড়কে ব্যক্তিগত অনেক গাড়ি পুড়েছে। সেসব ক্ষয়ক্ষতির হিসেব এখনো মেলেনি।
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের জালকুড়ি এলাকায় নম পার্কে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করেছে দুর্বুত্তরা। এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নম পার্কের স্বত্ত্বাধিকারী শাহ নিজাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যারা একাত্তর সালে স্বাধীনতা চায়নি, যারা উন্নয়নে বিশ্বাস করেনা ওই স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে এ দেশের অর্থনীতিকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ছাত্রদের ওপর ভর করে সারা দেশে এই তাণ্ডব চালিয়েছে। আমি শতভাগ বিশ্বাসী কোন সাধারণ ছাত্রের পক্ষে এই ধরণের কাজ করা সম্ভব না। যারা স্বাধীনতা বিশ্বাস করে না যেমন-ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির তাদের ইন্দনে এবং বিএনপি-জামায়াতের ইন্দনে সারা দেশে এই অগ্নিসন্ত্রাশের ঘটনা ঘটেছে। আমার নম পার্কে হামলা হয়েছে। মালামাল লুটপাট করেছে। নগদ অর্থ নিয়ে গেছে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
স্বাধীনতা বিরোধীতা এই হামলা চালিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন,‘ যেসব শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন করেছে তারা কোনভাবেই এই সহিংস আন্দোলনের দায়ভার গ্রহণ করছেনা। এমনকি তারা এর সাথে সম্পৃক্ত নয় বলে জানিয়েছেন।আমি মনে করি, এটা কোন ভাবে শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। এই সহিংস আন্দোলন পুরোটা করেছে জামায়াত-বিএনপি ও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি।
বিএনপি-জামায়াত এই তাণ্ডব চালিয়েছে উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, এই সহিংসতার ঘটনায় ৩১ টি মামলা হয়েছে; তাতে ৫৮৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী রয়েছে। বিএনপি-জামায়াত এই তাণ্ডব চালিয়েছেন। এছাড়া পিবিআই অফিস, পাসপোর্ট অফিস সহ এসবি গার্মেন্টে যারা সরাসরি অগ্নিসংযোগ করেছে এরুপ ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের তথ্য অনযায়ী, ফতুল্লা থানা জামায়াতে ইসলামের আমির মাসুদ মেম্বার, যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মামুনের নেতৃত্বে তারা সহিংস কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। সানারপাড় ও সাইনবোর্ড এলাকায় ইকবাল কাউন্সিলর ও ইস্রাফিলের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে জামায়াত-বিএনপি ও দুষ্কৃতিকারীরা তাণ্ডব চালিয়েছে। এতে পুলিশের ৩৭ জন সদস্য আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৪ জন গুরুতর আহত হয়ে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ জুলাই সকালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া এলাকায় বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করে পুড়িয়ে দেন। দুপুরে পুলিশের একাধিক টিম বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এভাবে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। বিকালে বঙ্গবন্ধু সড়ক, নবাব সলিমুল্লাহ সড়ক ও পুরাতন সড়কে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশের আরেকটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। দিনব্যাপী সংঘর্ষে শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হন। এভাবে ২২ জুলাই পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে পুরো নারায়ণগঞ্জ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
হাসপাতাল ও পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৮ জুলাই আহত শতাধিক, ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধসহ আহত চার শতাধিক, ২০ জুলাই চার জন নিহত ও গুলিবিদ্ধসহ আহত দেড় শতাধিক, ২১ জুলাই একজন নিহত ও আহত অর্ধশতাধিক এবং ২২ জুলাই তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়।
অর্ধশতাধিক স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। সেগুলো হলো- আন্দোলনের সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জেলা কার্যালয়, পাসপোর্ট অফিস, সিটি করপোরেশনের নগর ভবন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশ বক্স, পুলিশ ফাঁড়ি, পুলিশের গাড়ি, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব লিমিটেডসহ ছোটবড় অর্ধশতাধিক স্থাপনা ও কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর চালিয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পাশাপাশি ২৬টি বাস ও আরও ২০টি বিভিন্ন ধরনের যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। এখনও জেলা শহরের বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতচিহ্ন দেখা যাচ্ছে।